প্রতিদিন ভোর ৪:৩০ এ আমার ঠাকুরদাদা পূজার বেদীতে পবিত্র মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে তাঁর প্রিয় ঈশ্বরীয় শক্তির আবাহন করেন। পূজা সম্পন্ন হলে, তিনি ধ্যান করেন এবং তারপরে দীর্ঘ পদচারণার জন্য বেরিয়ে পরেন। তিনি বাড়িতে ফিরে আসার পরে প্রতিদিন উদাত্ত কন্ঠে বলে ওঠেন, "আহা, কি সুন্দর সকাল"।
ব্রহ্ম মানে জ্ঞান এবং মুহুর্ত মানে শুভ সময়কাল । ব্রহ্ম মুহুর্ত, জ্ঞান উপলব্ধির পক্ষে শুভ সময়কাল ।
ভোরবেলার সাথে আমার ঠাকুরদাদার বরাবর একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক আছে, বিশেষতঃ সূর্যোদয়ের আগে দেড় ঘন্টার ব্রহ্ম মুহুর্ত সময়কালে| এই সম্পর্ক এতই গভীর যে শীতকালে কষ্টকর ঠান্ডার মধ্যেও আপনি তাঁকে ভোরবেলায় তাঁর দৈনন্দিন কর্ম সম্পন্ন করতে দেখবেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, তাঁর আচারপদ্ধতিই তাঁর স্বাস্থ্যকে ধরে রেখেছে। (৮০ বছর বয়সেও, তিনি খাড়া ভঙ্গিতে হাঁটাচলা করেন, বসেন এবং তাঁর কোন রকম রোগ নেই।)
মনে হয়, আপনার চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরাও তাঁর সাথে একমত হবেন। আয়ুর্বেদের একটি গ্রন্থ অষ্টাঙ্গ হৃদয়ে বর্ণিত হয়েছে যে ব্রহ্ম মুহুর্তে ঘুম থেকে জেগে ওঠার অভ্যাস মানুষের আয়ু বাড়ায় এবং রোগ এড়াতে সহায়তা করে।
ব্রহ্ম মুহুর্ত : ‘আমার একান্ত’ সময় নতুন করে সংজ্ঞায়িত হয়েছে
রোগমুক্ত শরীর এবং একটি বর্ধিত জীবনকাল এর সুবিধাগুলো আমাদের কাছে আবেদন রাখে। যাইহোক আমার পিতামহের ভোরবেলার জন্য ভালোবাসা উদ্ভূত হয়েছে আরও গভীর কিছু থেকে। তাঁর নিজের কথায়, এটি তাঁর 'একান্ত' সময় । তিনি আমাকে এটি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, সকাল থেকে রাত অবধি, আমরা বিশ্বের চাহিদা মেনে চলছি। দিনটি ব্যয় করছি পেশাদার, সামাজিক এবং পারিবারিক দায়িত্ব পালনে। রাত্রিবেলায় খুব অল্প সময় পড়ে থাকে নিজের জন্য। কিন্তু সেই সময়, আপনার আর কোনও কর্মশক্তি বাকি থাকে না। একমাত্র সময়, যখন আপনি তাজা, সচেতন এবং সহজেই নিজের অন্তঃকরণের সঙ্গে সমন্বয় স্থাপন করতে পারেন তা হল ব্রহ্ম মুহুর্ত। এটি হোক আপনার চেতনায় স্থির হওয়ার একটি বিশেষ সময় ।
ব্রহ্ম মুহুর্তে ঘুম থেকে ওঠার গবেষণালব্ধ সুবিধা সমূহ
'ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ যোগ অ্যান্ড অ্যালাইড সায়েন্সেস' এর বিবৃতি অনুসারে ভোর হওয়ার ঠিক আগের সময়কালে বায়ুমণ্ডলে জায়মান অক্সিজেন উপস্থিতি থাকে। এই জায়মান অক্সিজেন সহজেই হিমোগ্লোবিনের সাথে মিশে গিয়ে অক্সিহিমোগ্লোবিন গঠন করে, যার নিম্নলিখিত সুবিধাগুলি রয়েছে :
- রোগ প্রতিরোধ প্রণালীকে সহায়তা দেয়
- প্রাণবন্ত করে তোলে
- রক্তের পিএইচ ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে
- ব্যথা, বেদনা এবং খিঁচুনি লাগা থেকে মুক্তি দেয়
- খনিজ এবং ভিটামিনগুলির শোষণ বৃদ্ধি করে
৫টি কাজ 'একান্ত' সময়ে করণীয়
আমাদের পূর্বপুরুষরা বুঝতে পেরেছিলেন যে ব্রহ্ম মুহুর্তে নির্দিষ্ট কিছু কর্ম নিজের চেতনার সঙ্গে সমন্বয় স্থাপন করতে পারে। এই কর্মকান্ড ব্যক্তিগত ও জাগতিক উভয় ক্ষেত্রেই সহায়তা করে, নিজের জীবনে এই সময়কালকে বিশিষ্ট এবং ফলপ্রসূ করে তুলতে। ধর্মশাস্ত্র, ধর্ম সম্পর্কীত হিন্দু গ্রন্থ এবং অষ্টাঙ্গ হৃদয়-এর মতো প্রাচীন গ্রন্থগুলি নিম্নলিখিত সুপারিশ দেয় :
১। ধ্যান
ধ্যান হল নিজের চেতনার সঙ্গে মিলিত হওয়ার সবথেকে ভাল উপায়। আর সারা বিশ্ব যখন নিদ্রামগ্ন, তখন ধ্যানের চেয়ে আর ভাল সময় কী হতে পারে? এই সময়ে আপনার সচেতনতার মাত্রা সবচেয়ে ভাল থাকে। সহজ সমাধি ধ্যান হল অন্যতম সেরা ব্রহ্ম মুহুর্ত ধ্যান।
২।. জ্ঞান সম্পর্কযুক্ত পড়া অথবা শোনা
অষ্টাঙ্গ হৃদয় অনুসারে, আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞা উপলব্ধি করার জন্য ব্রহ্ম মুহুর্তই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলি অনুসন্ধান করুন বা জ্ঞানের সহজ মতবাদগুলি পুনরায় উদ্ঘাটিত করুন। ধর্মশাস্ত্র অনুসারে, ব্রহ্ম মুহুর্তের সময় শাস্ত্র অধ্যয়ন মানসিক সমস্যাগুলিকে সহজ করতে সহায়তা করে।
৩। পরিকল্পনা
ব্রহ্ম মুহুর্ত আপনাকে যে সচেতনতার মাত্রা এবং সজীবতা প্রদান করে তা আপনার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিকল্পনা করার জন্য উপযুক্ত সময়। এটি হতে পারে কাজ, অর্থ অথবা আগামী দিন সম্পর্কীত ।
৪। অন্তর্দশন
আপনার গতকালের ক্রিয়াকলাপগুলি মনে করুন। ঈর্ষা, ক্রোধ এবং লোভের মতো নেতিবাচক আবেগগুলির কাছে কতবার পরাজয় স্বীকার করেছেন তা স্মরণ করুন। দেখুন, এই স্মৃতিগুলির কোনওটিই যেন আপনাকে অপরাধবোধে আচ্ছন্ন না করে। কেবল মাত্র ওই মুহুর্তগুলি সম্পর্কে সচেতন হন। প্রতিদিন এটি করার ফলে, এই আবেগগুলি কাছে আপনার পরাজয় স্বীকার করার প্রবণতা হ্রাস পাবে এবং অবশেষে খারাপ কর্ম হ্রাস পাবে।
৫। আপনার বাবা-মা, গুরু এবং ঈশ্বরকে স্মরণ করুন
আমরা প্রায়ই সময় পাইনা আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটিকে মনে করার। ঋষি শৌনক পরামর্শ দিয়েছেন যে, ব্রহ্ম মুহুর্ত সময়কালে আপনার পিতামাতা, গুরু এবং সেই শক্তি যা এই সৃষ্টিকে চালাচ্ছে বলে বিশ্বাসকরেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ান। এই শক্তিকে ঈশ্বর বা জাগতিক শক্তিও বলতে পারেন ।
৪টি নিষেধ - ব্রহ্ম মুহূর্তে না করার
ধর্মশাস্ত্রেও পরামর্শ দেয় কিছু নিষেধ এর বিষয়ে :
1. ভোজন করবেন না : ব্রহ্ম মুহূর্তে খাওয়ার ফলে শারীরিক অসুস্থতা দেখা যায়।
2. মানসিক চাপপরে এমন কাজ করবেন না : এমন কোনও কাজ করবেন না যাতে খুব বেশি মানসিক শ্রম দরকার হয়। এর ফলে আয়ু হ্রাস পায়।
সকলেরই কি ব্রহ্ম মুহূর্তে ঘুম থেকে ওঠা প্রয়োজন?
অষ্টাঙ্গ হৃদয় অনুসারে কেবলমাত্র সুস্থ সবল মানুষই ব্রহ্ম মুহূর্তে শয্যা ত্যাগ করবেন। এই পাঠ্য গ্রন্থ, নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের ব্রহ্ম মুহূর্তে ঘুম থেকে উঠতে নিষেধ করেছে :
১। গর্ভবতী মহিলা
২। শিশু
৩।প্রবীণ ব্যক্তি, যাঁর আগে থেকেই এই সময়কালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস নেই
৪। অসুস্থ ব্যক্তি, শারীরিক ও মানসিক কোনও ভাবে
৫। যে ব্যক্তির আগের ভোজনটি হজম হয়নি ( মলত্যাগ না হওয়া, ভোজন হজম হয়নি ইহা নির্দেশ করে)